‘
কে এম সাইফুর রহমান, নিজস্ব প্রতিনিধিঃ
তানভীর হাসান (ছদ্মনাম)। অত্যন্ত মেধাবী এই শিক্ষার্থী চিকিৎসা বিদ্যায় পড়া-লেখার সুযোগ পান দেশের স্বনামধন্য একটি সরকারি মেডিকেল কলেজে। সেখানে ভর্তির পর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এক নারী শিক্ষার্থীর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। পড়াশোনায় অমনোযোগী ও প্রেমঘটিত কারণে প্রথমবর্ষেই তার রেজাল্ট খারাপ হয়। এ নিয়ে মানসিক দুশ্চিন্তায় ভুগতে থাকা তানভীর হাসান বিষয়গুলো শেয়ার করেন সহপাঠীদের সঙ্গে। তারা প্রথমে গাঁজা সেবনে উৎসাহ দেন তাকে। আস্তে আস্তে তানভীর হয়ে ওঠে ভয়াবহ মাদকসেবী। একসময় বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় প্রেমের সম্পর্ক; মেডিকেল কলেজ থেকেও তাকে বের করে দেওয়া হয়। মাদকের নেশায় এতোটাই হীন হয়ে যান যে, মাদকের টাকা জোগাড়ে তিনি একসময় মাদককারবারে জড়িয়ে পড়েন।
তানভীরের চেয়ে ভিন্ন অভিজ্ঞতা সোহেল রানার (ছদ্মনাম)। তরুণ বয়সে পড়াশোনার পাশাপাশি গড়ে তোলেন গরুর খামার। খুব স্বল্প সময়ে সফলতাও পান তিনি। প্রতিদিন নগদ টাকা আসতে থাকে; এরপর নামেন ইজারা ব্যবসায়। স্থানীয় সিনিয়রদের মাধ্যমে প্রথমে ফেনসিডিল সেবন শুরু করেন। এরপর হেরোইন। তার পরিবর্তন দেখে পরিবার বিয়ে দিয়ে দেয়। দুই সন্তান থাকলেও তাদের দেখভালে বা সংসারের প্রতি তার কোনো মনোযোগ ছিলো না। ওদিকে ব্যবসায়ও ধ্বংস নামতে থাকে। দীর্ঘ একযুগ পর সোহেল বুঝতে পারেন তার সংশোধন হওয়া প্রয়োজন। পরিবারের সঙ্গে আলোচনার পর নিজেই ভর্তি হন মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রে। নিজের ভুল বুঝতে পেরে এখন আক্ষেপ করেন সোহেল। তানভীর ও সোহেল চিকিৎসা নেন বাংলাদেশ পুলিশের উদ্যোগে নির্মিত ওয়েসিস মাদক নিরাময়, পুনর্বাসন ও স্বাস্থ্য পরামর্শ কেন্দ্রে। মাদকের অন্ধকার জগতে পা বাড়ানো মানুষদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে আড়াই বছর আগে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার প্রায় আড়াই বছরে এমন অনেক গল্পের মানুষকে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছে ‘ওয়েসিস’।
‘ওয়েসিস’ এর বাংলা হলো মরূদ্যান, অর্থাৎ রুক্ষ বৃক্ষহীন মরুভূমিতে এক টুকরো সবুজ। দেশে যখন মাদকাসক্তির চিকিৎসা ও পুনর্বাসন- এ নাজুক অবস্থা, তখন ঊষর মরুভূমির মধ্যে সবুজ আর বারিবিন্দু নিয়ে মাদকাসক্তদের সেবা দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।
২০২১ সালের অক্টোবর মাসে পুলিশ কল্যাণ ট্রাস্টের উদ্যোগে রাজধানীর অদূরে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের বসুন্ধরা রিভারভিউ প্রকল্পে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে ‘ওয়েসিস’। অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর ও নান্দনিক পরিবেশে উন্নত ব্যবস্থাপনায় দেশের সবচেয়ে অত্যাধুনিক মাদক নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্র এটি। এখানকার চিকিৎসা পদ্ধতি, পরিবেশ এবং সবার আন্তরিকতা খুবই চমৎকার।
বর্তমানে ওয়েসিসের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার অতিরিক্ত আইজিপি হাবিবুর রহমান বিপিএম (বার), পিপিএম (বার)। প্রতিষ্ঠানটি থেকে এখন পর্যন্ত দুই শতাধিকের বেশি মাদকাসক্ত নারী-পুরুষ চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছেন।
ওয়েসিসে চিকিৎসা নেওয়া তানভীরের পরিবার আমাদের প্রতিনিধিকে বলেছিলো, তারা যখন বুঝতে পারেন তানভীর কঠিনভাবে মাদকে জড়িয়ে পড়েছে তখন একটি মাদক নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি করানো হয়। কিন্তু কিছুদিন পর সেখান থেকে ফিরে সে পুনরায় মাদক সেবন ও বিক্রিতে জড়িয়ে পড়ে। এভাবে একাধিক নিরাময় কেন্দ্রে তাকে চিকিৎসা করানো হলেও কোনো সুফল পাননি তারা। সর্বশেষ তাকে ওয়েসিসে ভর্তি করানো হয়। ফয়সাল নিজেও আমাদের প্রতিনিধিকে বলছিলেন, ‘এবার সে অতীতে করে আসা সব ভুল বুঝতে পারছেন। এখানে ভর্তি হওয়ার পর পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ছেন, হাদিসের বই পড়েন, জিম করেন, বিকালে ছাদে হাঁটাহাটি করেন। তাছাড়া ওয়েসিসের খাবারের মানও অনেক উন্নত। যার ফলে তার কাছে মনে হয়, তিনি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেই বসবাস করছেন।’
প্রতিষ্ঠানটির শুরু থেকেই এখানে কাজ করছেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মোর্তজা হাসান। আমাদেরকে তিনি বলেন, ‘এখানে যেসব রোগী আসেন তাদের বেশির ভাগ হেরোইন, ইয়াবা, ফেনসিডিল, গাঁজাসহ নানা ধরনের মাদকে আসক্ত। এক্ষেত্রে প্রকারভেদে তাদের বিভিন্ন চিকিৎসা দেওয়া হয়।’
এই পুনর্বাসন কেন্দ্রে ইয়াবা আসক্ত রোগী বেশি জানিয়ে এই চিকিৎসক বলেন, ‘ইয়াবা বহন করা সহজ। একারণে এই নেশায় বেশি মানুষ আসক্ত হয়। এরপরেই গাঁজাসেবীর সংখ্যা। এটার কারণ খরচ কম, ইয়াবার মতো বহনও সহজ।’
বর্তমানে ওয়েসিসের সক্ষমতা কতটুকুঃ
——————————————
জানতে চাইলে মোর্তজা হাসান বলেন, ‘অন্যান্য হাসপাতাল বা নিরাময় কেন্দ্র যেসব সুযোগ-সুবিধা দিতে পারবে আমরা তার থেকে আরও বেশি কিছু দিতে পারবো। এক্ষেত্রে আমরা দেশের অন্যতম প্রতিষ্ঠান হিসেবে ওয়েসিসকে তুলনা করতে পারি। কারণ, অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে সাইক্রেটিস্টরা অনকলে বা সপ্তাহে একবার রোগী দেখেন। কিন্তু আমরা প্রতিদিন রোগী দেখি। যদি রাতে নাও থাকি অন্যান্য চিকিৎসাকরা বিষয়টি জানালে চিকিৎসা দেওয়া হয়। অন্য প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসা নিয়ে আসা অনেকে এখানে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তারাই বলেছেন- সেখানকার চিকিৎসা ব্যবস্থা আর এখানকার চিকিৎসা পুরোপুরি ব্যতিক্রম।’
সরেজমিনে ওসেসিসে ঘুরে দেখা গেছে, ৭তলা ভবনের নিচতলায় নিরাপত্তাকর্মীদের কক্ষ। যেখানে পুলিশ সদস্যরা শিফট ভেদে ডিউটি করেন। এর পাশেই আউটডোরে রোগী দেখার রুম রয়েছে। পাশেই নিজস্ব রান্না ঘর। সেখানেই প্রতিবেলায় রোগীদের রান্নার কাজ চলে।
ভবনের ১ তলা থেকে ৩ তলা পর্যন্ত মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের আবাসিক ব্যবস্থায় চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হয়। পাশাপাশি ভবনটিতে রয়েছে সর্বাধুনিক প্যাথলজি ল্যাব। এসি ফ্লোর, জেনারেল বেডের ওয়ার্ড, ফায়ার ফাইটিং ব্যবস্থা, বিশেষ কেবিন ও ইনডোর গেমসের ব্যবস্থা। শুধু খেলাধুলাই নয়, পড়ালেখার জন্য লাইব্রেরীর সুব্যবস্থাও আছে এখানে।
এছাড়াও রয়েছে নার্সিং স্টেশন। এর ঠিক ওপরেই গড়ে তোলা হয়েছে সুসজ্জিত বাগান। প্রাকৃতিক পরিবেশে বিকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত রোগীদের জন্য ইয়োগা ও মেডিটেশন করার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে বাগানে।
ছাদবাগানের পাশেই রয়েছে ব্যায়ামাগার। অর্থাৎ মাদকাসক্তদের পরিপূর্ণ সেবা দিতে সরকারের সব বিধিমালা মেনেই গড়ে তোলা হয়েছে ‘ওয়েসি
Leave a Reply