২৩ জুন, জাতি গঠনের প্রতিটি সোপান এবং স্বাধিকার আন্দোলনের প্রতিটি ধাপে অবদান রাখা এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশের স্বাধীনতা অর্জনে নেতৃত্ব দানকারী রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ৭২তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী।
স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় ঐক্যের রুপকার আওয়ামী লীগ বাঙ্গালী জাতির স্বতন্ত্র জাতিরাষ্ট্র ও আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠার সুমহান ঐতিহ্যের প্রতীক। আধুনিক বাংলাদেশ ও আওয়ামী লীগ যেন এক সূতোয় গাঁথা। আওয়ামী লীগের ইতিহাস, রক্তের ইতিহাস। উপমহাদেশের ঐতিহ্যবাহী এ দলের সবচেয়ে বড় শক্তি তার সুবিশাল কর্মী বাহিনী ; যারা দেশ ও দলের প্রয়োজনে অতীতে কখনো রক্ত দিতে কুন্ঠাবোধ করেনি। আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমে এ দেশের সকল অর্জনই যেন আওয়ামী লীগের কর্মীদের শ্রম ও রক্তের ফসল। মহান স্বাধীনতার সূবর্ণ জয়ন্তীর এ বর্ষে স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী এ দলের ৭২ তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী তাই অন্যরকম গুরুত্ব বহন করে।
১৯৪৭ সালে বৃটিশ শাসনের অবসান এবং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর মুসলিম লীগের দুঃশাসন ও প্রচন্ড দমননীতির মুখে এক প্রবল বৈরী পরিবেশে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার কে এম দাশ লেনের রোজ গার্ডেনে এক কর্মী সম্মেলনের ভেতর দিয়ে আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ করে আওয়ামী লীগ।
মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সভাপতি, টাংগাইলের সামচুল হক সাধারণ সম্পাদক এবং কারাগারে বন্দী অবস্থায় শেখ মুজিবুর রহমান অন্যতম যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন। অচিরেই আওয়ামী লীগ হয়ে উঠে পূর্ব বাংলার জনগণের স্বার্থরক্ষাকারী সুসংগঠিত রাজনৈতিক শক্তি।
প্রতিষ্ঠার সময়ে ” পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ ” নাম ধারণ করলেও ১৯৫৫ সালে ধর্মনিরপেক্ষতাকে আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করে দলের নামকরণ করা হয় “পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ”।
৫২’র ভাষা আন্দোলনের বিজয়ের বিজয়ের পটভূমিতে ১৯৫৪ সালে তিন জাতীয় নেতা শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে গঠিত যুক্তফ্রন্টের নিরংকুশ বিজয় গণতান্ত্রিক অভিযাত্রাকে নতুন পর্যায়ে উন্নীত করে ; যার পিছনে আওয়ামী লীগ ছিল মূল চালিকাশক্তি।
কুটিল প্রাসাদ ষড়যন্ত্র ও বিভেদ সত্ত্বেও পূর্ব বাংলার দুই বছরের আওয়ামী লীগ শাসন এবং কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন কোয়ালিশনের এক বছরের শাসন ছিল গণতন্ত্র বিকাশের বিপুল সম্ভাবনার সময়। পূর্ব বাংলায় আওয়ামী লীগ সরকার নিশ্চিত করতে পেরেছিলো এক মুক্ত গণতান্ত্রিক পরিবেশ।
আওয়ামী লীগের উদ্যোগেই তখন বাংলা অন্যতম রাষ্ট্র ভাষার আনুষ্ঠানিক রাষ্ট্রীয় মর্যাদা লাভ করে ; ২১ ফেব্রুয়ারি ঘোষিত হয়- শহীদ দিবস, জাতীয় ছুটির দিন।। শুধু তাই নয়- তৎকালীণ আওয়ামী লীগ সরকারের উদ্যোগেই কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের নির্মাণ কাজ প্রায় সম্পন্ন হয়; প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলা একাডেমি।
এ সময়ে তৃণমূল পর্যায়ে দলীয় সংগঠন গড়ে তোলার কাজে আত্মনিয়োগ করার জন্য শেখ মুজিবুর রহমান মন্ত্রিত্ব ত্যাগ করে এক অনন্যসাধারণ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। তাই আজও আওয়ামী লীগ তৃণমূলে অত্যন্ত শক্তিশালী গণমানুষের দল হিসেবে পরিচিত।
১৯৫৬ সালের সংবিধানের আন্দোলন, ১৯৫৮ সালের সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন, ১৯৬২ সালের শিক্ষা কমিশন বিরোধী আন্দোলন, দুই দশকের বঞ্চনা, ১৯৬৪ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং ১৯৬৫ সালে সংঘটিত পাক – ভারত যুদ্ধের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির মুক্তির সনদ ছয় দফা কর্মসূচি উত্থাপন করেন। এই দাবি সমগ্র বাঙ্গালি জাতিকে সহসা সচকিত করে তোলে। শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকারের এ আন্দোলন অভূতপূর্ব জাতীয় জাগরণের সৃষ্টি করে। ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী।
ফলে ১৯৬৬ সালের মে মাসে শেখ মুজিবসহ আওয়ামী লীগের বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়; রুজু করা হয় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। ১৯৬৯ সালে ছাত্র সমাজের নেতৃত্বে ৬ দফা ভিত্তিক ১১ দফা আন্দোলন
গণ- অভ্যূত্থানে পরিণত হলে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করতে সরকার বাধ্য হয়। শেখ মুজিব মুক্ত হয়ে ফিরে এলে ছাত্র – জনতা তাঁকে ” বঙ্গবন্ধু ” উপাধিতে ভূষিত করে। এর পরে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে ১৬৯ টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসনে জয়লাভের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ বাংলার জনগণের নিরংকুশ সমর্থন লাভ করে এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আবির্ভূত হন বাংলার গণ মানুষের অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে।
এরপরই শুরু হয় নতুন ষড়যন্ত্র। বাঙ্গালীদের কাছে তথা আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করার লক্ষ্য থেকেই ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ ঢাকায় আহুত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ১ মার্চ স্থগিত ঘোষণা করা হলে লক্ষ-কোটি বাঙালি স্বাধীনতার দাবিতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাজপথে নেমে আসে।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে স্বাধিকার আন্দোলন রুপান্তরিত হয় স্বাধীনতা সংগ্রামে। অতঃপর
৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধুর সেই জগৎ বিখ্যাত ভাষন, যার মাধ্যমে কার্যত: তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দেন এবং স্বাধীনতার লক্ষ্য অর্জনে চুড়ান্ত সংগ্রামের আহ্বান জানিয়ে জাতিকে দেন সুস্পষ্ট দিক- নির্দেশনা। ২৫ মার্চ কালরাতে হানাদার বাহিনী নিরীহ বাঙালির উপর ঝাপিয়ে পড়ে এবং ২৬ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করার পূর্বে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। অত:পর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে পরিচালিত ৯ মাসের বীরোচিত মুক্তিযুদ্ধের ত্রিশ লক্ষ শহীদদের রক্ত ও দুই লক্ষ মা বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ চুড়ান্তভাবে স্বাধীনতা অর্জন করে।
এভাবেই বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের হাত ধরে বিশ্বের মানচিত্রে স্থায়ীভাবে জায়গা করে নেয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ আর বাঙালি পায় তাঁদের স্বপ্নের স্বাধীনতা ও প্রাণের লাল-সবুজ পতাকা।
Leave a Reply