কাশিয়ানী (গোপালগঞ্জ) প্রতিনিধি:
কাশিয়ানী হানাদার মুক্ত দিবস ১৯ ডিসেম্বর। ১৯৭১ সালের এই দিনে গোপালগঞ্জ জেলার কাশিয়ানী উপজেলা হানাদার মুক্ত হয়। মিত্রর ও মুক্তিবাহিনীর ত্রিমুখী আক্রমণে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দখলে থাকা কাশিয়ানীর ভাটিয়াপাড়া ওয়্যারলেস স্টশন ঘাঁটির পতন ঘটে।
দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয় ১৬ ডিসেম্বর অর্জিত হলেও কাশিয়ানীর ভাটিয়াপাড়ায় স্বাধীন বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা ওড়ে ১৯ ডিসেম্বর সকালে।
এ উপলক্ষে প্রতিবছরের ন্যায় এ বছরও স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্যোগে যথাযোগ্য মর্যাদায় মুক্ত দিবসটি পালিত হয়েছে।
গতকাল (১৯ ডিসেম্বর) দিনব্যাপী গোপালগঞ্জ কাশিয়ানীর ভাটিয়াপাড়া শহীদ স্মৃতি ক্লাবে ও শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতিস্তম্ভ (বধ্যভূমিতে) নানা আয়োজনে দিবসটি পালন করা হয়।
দিবসের প্রথমে সকাল ১০টায় শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিস্তম্ভে ফুলের শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করা হয়। পরে শহীদ স্মৃতি ক্লাব প্রাঙ্গণে মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশ ও আলোচনা সভা এবং শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের রুহের মাগফেরাত কামনায় দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়।
এ অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন মুহাম্মদ ফারুক খান (এমপি)।
এ মুক্ত দিবসে বীর মুক্তিযোদ্ধা, কে এম মানোয়ারুল করিম খান লাভলুর সভাপতিত্বে ও উপজেলা আ, লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক মোঃ মশিউর রহমান খানের সঞ্চালনায়,
জেলা আ, লীগের মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা খন্দকার সিরাজুল ইসলাম, সদস্য এম এ খায়ের মিয়া, উপজেলা আ, লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ মোক্তার হোসেন, সাধারণ সম্পাদক কাজী জাহাঙ্গীর আলম, বীর মুক্তিযোদ্ধা আফজাল হোসেন, গোলাম মাওলা, কাজী হারুন অর রশিদ, সদর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মোঃ আনোয়ার হোসেন আনু বক্তব্য রাখেন।
এছাড়াও শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা, আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ এবং গণমাধ্যমের কর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।
বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বক্তব্যে জানা যায়, ১৯৭১ সালে এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে ফরিদপুর থেকে এক প্লাটুন পাকিস্তানি সেনা রেলযোগে কাশিয়ানী অদূরবর্তী ভাটিয়াপাড়া ওয়্যারলেস সেন্টার দখল করে সেখানে অবস্থান নেয়। তারপর স্থানীয় মুসলিম লীগ ও পিডিপি নেতাদের সহযোগিতায় শান্তি কমিটির মাধ্যমে রাজাকার আল বদর ও আল-শামস বাহিনী গঠন করে এলাকায় লুটতরাজ ,খুন অগ্নিসংযোগ ও নারী ধর্ষণসহ বিভিন্ন অপরাধ অত্যাচার নিপীড়ন চালাতে থাকে।
১৩ এপ্রিল আওয়ামী লীগের নেতা এম এম আজাদ হোসেন, বাগঝাপা গ্রামের মুক্তার শেখ, মাজড়া’র হাবিবুর রহমান বাবু মিয়ার বাড়িসহ শতাধিক আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে হানাদার বাহিনী। তারা মাজড়া গ্রামের জহিরউদ্দিন মৌলভীর ছেলে বেলায়েত, যদু মিয়ার স্ত্রী ও বাগঝাপার আক্কাস শেখকে গুলি করে হত্যা করে। পরদিন ১৪ এপ্রিল পোনা গ্রামের ৬ টি বাড়িতে আগ্নসংযোগ এবং ১১ জনকে গুলি চালিয়ে হত্যা করে। এভাবে দিন দিন পাকিস্তানি সেনাদের অত্যাচার বাড়তেই থাকে। তারা কাশিয়ানী উপজেলার প্রায় ৫ শতাধিক বাড়িতে অগ্নিসুযোগ ও লুটতরাজ করে। শত শত নারী ধর্ষণের শিকার হয়।
মে মাসের শেষ দিকে ফিরোজ খালিদ ও আক্কাস হোসেনের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা এলাকায় গেরিলা যুদ্ধ শুরু করেন। জুলাই-আগস্ট মাসে ভারত থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা এলাকায় ঢুকে যুদ্ধ শুরু করেন। ওরাকান্দি মিড হাইস্কুলে মুক্তিযুদ্ধের কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিল গঠন করে ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন স্থানীয় এমএলএ নুরুল কাদির জুনুর ছোট ভাই ইসমত কাদির গামা।
এছাড়া রামদিয়া এস কে কলেজ, সাজাইল গোপী মহন হাইস্কুল, রাতইল স্কুল, জয়নগর স্কুলসহ অনেক স্থানে মুক্তিযোদ্ধারা ক্যাম্প স্থাপন করে গেরিলা যুদ্ধ চালাতে থাকেন। অক্টোবর মাসে উপজেলার ফুকরা লঞ্চঘাট এলাকায় খুলনা থেকে তিনটি লঞ্চযোগে আসা পাক-সেনাদের সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর ৬ ঘন্টা ধরে মুখোমুখি যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে ১৩ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। মুক্তি সেনারা পাকবাহিনীর একটি লঞ্চ ডুবিয়ে দেন ও দেড় শতাধিক পাকিস্তানি সেনাকে হত্যা করেন।
নভেম্বর মাসের শেষের সপ্তাহ নাগাদ কাশিয়ানী অধিকাংশ এলাকা শত্রুমুক্ত হলেও শতাধিক পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার কাশিয়ানী ভাটিয়াপাড়া ওয়্যারলেস সেন্টারে সুরক্ষিত বাঙ্কার করে অবস্থান নেয়। কাশিয়ানীর প্রায় ১ হাজার ২০০ মুক্তিযোদ্ধা চারিদিক থেকে সেই ক্যাম্পে আক্রমণ চালাতে থাকেন।
Leave a Reply